এইচ এম জাকিরঃ নেই কোনো নিয়ম নীতি নেই কোনো অনুমতি, সবই যেনো ক্ষমতার বাহাদুরি। কোন ধরনের নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করে জেলা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নে সিকদার ব্রিকস নামের ইটভাটায় চলছে ইট পোড়ানোর কাজ।
গেলো বছর জেলা প্রশাসনের বরাবর একখানা দরখাস্ত দিয়েই যেনো থেমে নেই ইটভাটার কার্যক্রম। একের পর এক মানুষের জায়গা জমি দখল ও কৃষি জমির মাটি কেটে চলছে ইট তৈরির কাজ। এমনকি ইট ভাটা স্থাপনে একেবারেই দখল করে নিয়েছে তেঁতুলিয়ার নদীর শাখা নদী হিসেবে পরিচিত বহুবছরের ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো কালির দোন খাল।
সরকার যখন নীতিমালার মধ্য দিয়ে ইটভাটাগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছেন, ঠিক তখনই কিছু অসাধু ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই একের পর এক ইটভাটা তৈরী করে সেখানে পোড়াচ্ছেন বনের কাট। তাতে করে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ প্রতিবেশ, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছেন লাখ লাখ টাকা বাৎসরিক রাজস্ব।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী বাঘমারা ব্রীজের দক্ষিণ দিকে নুরু মেম্বারের বাড়ীর পিছনে দক্ষিণ বালিয়ার ৮৯৪/৮৯৫ নং দাগের লালপুর মৌজায় তেঁতুলিয়ার শাখা নদী কালির দোন খাল ভরাট করে সিকদার ব্রিকস নামে ইটভাটা স্থাপন করেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মোঃ আলী আকবর।
গেলো বছরের ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি দরখাস্ত জমা দিয়েই খাল দখল করে শুরু করেন ইটভাটা স্থাপনের কাজ। চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই ওই ভাটার চারিদিকের কৃষি জমি ও সাধারণ মানুষের জায়গা দখল করে জোরপূর্বক সেখান থেকে মাটি কেটে ইট তৈরির কাজ করে আসলেও এখন পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইটভাটার অনুমোদনই দেয়া হয়নি।
এরপরেও ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনের নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে ইটভাটা স্থাপন করে রীতিমতো সেখানে করছে ইট তৈরির কাজ।
অথচ ২০১৭ সালের দিকে সেখানেই মিঠু মাতাব্বরের মালিকানাধীন বাবা-মায়ের দোয়া নামে অপর একটি ইটভাটা স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইট পোড়ানোর কাজ চলে আসলেও বৈধ কাগজপত্র না থাকা ও খাল ভরাট করে ইটভাটা তৈরি করায় তৎকালীন এডিএম আব্দুল হালিম মোটা অংকের জরিমানার মধ্য দিয়ে ব্রিকফিল্ডটি বন্ধ করে দেন।
দীর্ঘ ছয় বছর পর ওই ভাটার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে একই স্থানে একই ভাবে মোঃ আলী আকবর নামের প্রভাবশালী ব্যক্তি সিকদার ব্রিকস নামে ইটভাটা স্থাপন করেন।
যদিও অনুমোদনহীন ইটভাটা নিয়ে এলাকাবাসীর কোন ধরনের অভিযোগ না থাকলেও বহু বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী তেঁতুলিয়ার শাখা নদীর কালির দোন নামক খালটি দখল করে সেখানে ইটভাটা স্থাপন করায় তা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কেননা এই খালটি দিয়ে খেয়াঘাট হয়ে খোরশেদ খা ঘাট, খায়ের হাট, শান্তির হাট, নাছির হাওলাদার ঘাট, ভেলুমিয়া বাজার, ধুলিয়া, কালাইয়া, কবাই হয়ে কালিশ্বর যাতায়াত করা হতো। তাতে করে বিভিন্ন মালামাল পরিবহনে স্থানীয়দের যেমন উপকার হতো তেমনি এই খালের পানির আশেপাশে থাকা বহু কৃষি জমিতে ধান সহ বিভিন্ন ফসল আবাদ হতো।
সেখানকার বাসিন্দা আবু জাফর জানান, বহু বছর যাবত এই খালটির উপরই নির্ভর করেই এ অঞ্চলের মানুষদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, মাছ সম্পদসহ বহু মানুষ তাদের জীবন-যাত্রা নির্বাহ করতো। দিনে দিনে খালটির দখল হয়ে এখন তা একেবারেই মরে গেছে। অপর বাসিন্দা শফিউল্লাহ বলেন, খালটি এক সময়ে ছিলো ১৮০ফিট। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য খালটিকে ভরাট করে ফেলেছে। যার কারণে খালটি এখন মৃত প্রায়।
স্থানীয় চাষী সিরাজ মিয়া বলেন, তেতুলিয়া নদীর শাখা খালটি ভরাট করে ইটভাটা স্থাপন করাতে আমাদের জীবনের চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। এখন কৃষি জমিতে সেচ দিতেও আমাদেরকে অনেকটা বিড়ম্বনে পড়তে হচ্ছে।
একই কথা বলে স্থানীয় হারুন অর রশিদ জানান, সিকদার ইটভাটার মালিক আলী হোসেন খুব ক্ষমতাবান। কথায় কাথায় তিনি প্রশাসনের ভয় দেখান। সে কতোবড় ক্ষমতাবান হলে এভাব সরকারি খাল দখল করে ইটভাটা তৈরি করে। এর বাহিরেও তিনি বটতলা বালিয়া খালের পাশে শত শত মন লাকড়ি রেখে রাতের আধারে সেখান থেকে অল্প অল্প করে লাকড়ি ইটভাটায় এনে পোড়ান।
যদিও প্রশাসনসহ সকল ঘাট ম্যানেজ করে ইটভাটায় ঈদ পোড়ানোর কাজ বলে দাবি করে ভাটার মালিক আলী আকবর বলেন, আমার টাকা আছে বলেই প্রশাসন আমাদের কাছে গড়াগড়ি করে। পরক্ষণে খাল ভরাট করে ইটভাটা নির্মাণের বিষয় জানতে চাইতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, আপনি যা পারেন তা লিখেন। আপনার সাথে এতো কথা বলার আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তোতা মিয়া জানান, ৫-৬ বছরের আগের ইটভাটার পরিবেশের অনুমতি-টি-ই সে পুনরায় নবায়ন করেছে। বর্তমানে খাল ভরাট করে নতুন ভাবে ইটভাটা করলো এটা দেখেও আপনি কিভাবে নবায়ন করলেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তোর দিতে পারেননি।
স্থানীয় প্রশাসন (চেয়ারম্যান) এবং জেলা প্রশাসনের অদক্ষতার কারণেই এসব ইটভাটা অবৈধভাবে ইট তৈরী করেন এবং নদী দখল করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে বলে মন্তব্য করেন ভোলা পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতা মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী।
বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ আরিফুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য জেলার সাত উপজেলায় ১১৫টি ইট ভাটার মধ্যে ৮০টি ইটভাটার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও সিকদার ব্রিকস সহ ৩৫টি ইটভাটা চলছে সম্পূর্ণ অনিয়ম তান্ত্রিক ও অবৈধ উপায়ে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত