এইচ এম নাহিদঃ ভোলার ইলিশায় ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত সিসি ব্লগ বাঁধ যেন এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে দুজনের প্রাণহানি সহ হতাহত হয়েছে বহু মানুষ।
মেঘনার ভাঙ্গন থেকে ভোলাকে ও ভোলার জনগণকে রক্ষায় ২০১৭ সালের শেষের দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ফেরিঘাট সহ এর আশেপাশে এলাকায় নদীর তীর সংরক্ষণে ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় সিসি ব্লক। ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার বছরখানেক যেতে না যেতেই বাঁধের প্রায় দেড়শ মিটার এলাকা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দেবে গেছে আরো ৫০ মিটার এলাকা। এতে করে চরম ঝুঁকি ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে ওই এলাকার প্রায় ৩০ হাজার মানুষসহ কয়েক হাজার স্থাপনা।
ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আপদ কালীন ধস ঠেকাতে অপরিকল্পিত জিওব্যাগ ডাম্পিং’র কাজ শুরু করলেও সাধারণদের হতাহত ঠেকাতে এখনো নেয়া হয়নি স্থায়ী কোন পদক্ষেপ। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চরম আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
তারা বলছেন, চলতি বর্ষায় পাউবোর ভোলা শহর রক্ষা বাঁধে ব্যাপক হারে ধসে পরে কয়েকটি ইউনিয়নে মেঘনার পানি ঢুকে শহর প্লাবিত হওয়ার ও বহু মানুষ হতাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অপরিকল্পিত ব্লক স্থাপন, অনিয়ন্ত্রিত জিও ব্যাগ ডাম্পিং, কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও মেঘনায় অপরিকল্পিত বালু মহল ঘোষণাকেই দুষছেন স্থানীয়রা।
এ সকল বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ইলিশা সহ এর আশেপাশের ইউনিয়ন গুলোকে মেঘনার করাল গ্রাস থেকে রক্ষায় সিসি ব্লক দ্বারা নির্মিত নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধের সকল ধরনের অনিয়ম খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এমনকি ব্লক ধস ঠেকাতে এখনই স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ৭ জানুয়ারি ২০১৭ সালে ভোলা শহরকে রক্ষার জন্য রাজাপুর ইউনিয়নের তেমাথা থেকে পূর্ব ইলিশা ইউপির দালাল কান্দি পর্যন্ত ২৮০ কোটি টাকা ব্যায়ে ইনফ্রাটেক এনজেডকে(জেভি) নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের চার গ্রুপের কাজ পায়। ৪ বছরে প্রকল্পটির আরো ৫৫ কোটি টাকার বরাদ্ধ বেড়ে মোট ৩৩৫ কোটি টাকায় সমাপ্ত করে।
প্রাথমিক ভাবে ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ তৈরী করে অবশিষ্ট ৯০ হাজার ব্লক অতিরিক্ত রেখে আপদ কালীন সংস্কার করার কথা ছিল। কিন্তু ৩ বছর পর ভোলা শহর রক্ষা বাঁেধর উল্লেখিত পয়েন্টে মাত্র ২২ দিনের মাথায় ২ দফায় সিসি ব্লক ধসে পরে সাধারন পথচারি হতাহত হলে পাউবো আপদ কালীন সংস্কারের জন্য লোকাল বালি দিয়ে জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ শুরু করে, অথচ অতিরিক্ত সেই ৯০ হাজার সিসি বøকের কোন অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এনিয়ে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ( পাউবো)’র মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা কোন কথা বলতে রাজি হয়নি।
অন্যদিকে ইমারজেন্সী জিও ব্যাগ ডাম্পিং নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে অভিযোগ রয়েছে। তারা বলছেন, ৩ টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মের্সাস বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং, মের্সাস ড্রিম হোম ও মের্সাস স্বৃতি এন্টার প্রইজের মাধ্যমে পাউবো প্রায় ২২ কোটি টাকার জিও ব্যাগ ডাম্পিং’র যে কাজ করছে তা অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিতহীন মনিটরিং’র কারনে শহর রক্ষা বঁেধর কোন কাজেই আসবেনা। পাউবো শুধু শুধু রাষ্ট্রের অর্থ জলে ফেলছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিনিধি খোকন দেবনাথ’র কাছে ডাম্পিং’র বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেও পরে তার সম্পৃক্ততার বিষয় শিকার করে বলেন, আমরা কাজে কোন অনিয়ম করছিনা। সব কিছু ঠিকঠাক মতই হচ্ছে।
ইলিশা বাঁচাও আন্দোলন কমিটিরি পক্ষে এ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম ও সাংবাদিক ইয়ামিন হোসেন বলেন, উত্তাল মেঘনার ভাঙ্গনের কবল থেকে ভোলা শহরকে রক্ষা করার জন্য তৎকালিন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী অতিরিক্ত ৯০ হাজার ব্লকের হদীস, প্রকল্পের অনিয়মের সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক কিসের প্রলভন পেয়ে ভোলার মেঘনাকে বালু দস্যুদের কাছে ইজারা দিয়ে কাদের পকেট ভারি করার দায়িত্ব নিলেন তার সঠিক তদন্ত করে রাষ্ট্রযন্ত্র গুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা ভোলার ভাঙ্গনকবলীত মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তিনিই পারেন আমাদেরকে এই ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যাবস্থা করতে।
ভোলা দুর্ণীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারন সম্পাদক মোবাশ্বির চৌধুরী বলেন, যতদিন এই প্রকল্পটির তদারকি ড. কাজী তোফায়েল অহমেদ করেছেন ততদিন কাজের মান ভালোই ছিলো। যখন একটি দূর্ণীতিবাজ চক্র ওনাকে সড়িয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মিলে কাজটি করেছেন তখন ভোলা শহর রক্ষাবাঁধটির স্থায়ীত্ব নিয়ে ভোলাবাসীর মনে শঙ্কা জাগে। এখন যা হবার তাই হয়েছে। আমরা আশা করবো সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ভোলার সব গুলো বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কাজের জন্য তদন্ত কামিটি গঠন করে বা দুর্ণীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে এর সঠিক ব্যাবস্থা নিয়ে ড. তোফায়েলদের মত কর্মকর্তা বা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কাজ করে ভোলাকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করা।
এনিয়ে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারি পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ কারিদের সকল তথ্য মিথ্যা, আপদ কালীন কাজে কোন অনিয়ম হচ্ছেনা।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ম. হাসানুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, ৯০ হাজার অতিরিক্ত বøক রাখার কথা ছিল কিন্তু জমির কোন ব্যাবস্থা না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। সিসি ব্লকের পার দখলের বিষয়য়ে কয়েকবার পদক্ষেপ নিয়েছি কিন্তু কেউ কথা শুনেনা। কেউ নিষেদ না মানলে আমাদের কি করনীয় আছে। আর আপদ কালীন জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন অনিয়ম করার সুযোগ নেই। আমরা সার্বক্ষনিক বিষয়টি মনিটরিং করছি।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত