এছাড়া নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪/৫ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, কুকরি-মুকরি ইউনিয়ন তলিয়ে গেছে পানির নিচে। এছাড়া মনপুরা, লালমোহন ও দৌলতখান উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ও সকলে এলাকার লক্ষাদিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্বিষহ ভাবে জীবন যাপন কাটাচ্ছেন। সেখানকার বহু মানুষের পুকুর ও মাছের ঘের, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, সহ তলিয়ে গেছে বহু স্থাপনা।
তাছাড়া বিভিন্ন স্থানের জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেরিবাধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৩০ গ্রাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, রোববার সকাল থেকেই শুরু হয় তীব্র বাতাস। এর সাথে বাড়তে থাকে নদীর পানি। দুপুরের মধ্যেই তলিয়ে যায় চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন ঢালচর ও কুকরি-মুকরি। বিকেল নাগাদ নদীতে ভাটা শুরু হওয়ার সাথে পানির পরিমাণ কমতে শুরু করলেও গভীর রাতে বাতাসের গতিবেগ আরো বৃদ্ধি পেয়ে রাতভর চলতে থাকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল এর তান্ডবলীলা। তীব্র বাতাসে জেলার সাত উপজেলায় প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। উপরে পড়েছে সহস্রাধিক গাছপালা সহ অসংখ্য বিদ্যুতের খুঁটি।
এদিকে ঘর চাপায় ও গাছের চাপায় লালমোহন, বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখান উপজেলায় শিশু, নারী, পুরুষ সহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো ২০ জন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মনেজা খাতুন তার এক নাতীকে নিয়ে ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। ভোর আনুমানিক ৪ টার দিকে ঝড়ো বাতাসে তার টিনের ঘরটি ভেঙে ঘরের নিচেই চাপা পড়েন তিনি। এমত অবস্থায় স্থানীয়রা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
একইভাবে দৌলতখান উপজেলার পৌর ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রতিবন্ধী মুমিনের শিশু কন্যা মাইশা ঘরে থাকাকালীন সময়ে ঘরের পাশে থাকা গাছ ঘরের উপর উপড়ে পড়ে তার মৃত্যু হয়। আবুল কাশেম নামে ওই উপজেলায় আরো একজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া সোমবার সকাল ১১ টার দিকে বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাচড়া ইউনিয়ন ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম (৫০) এর মৃত্যু হয়। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথিমধ্যে গাছের একটি বড় ডাল ভেঙে তার পেটে ঢুকে যায়। এ সময় তার চিৎকার চেঁচামেচিতে স্থানীয়রা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একই ভাবে সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়ের ব্যাংকের হাট বাজার এলাকার সংলগ্ন ঘর চাপায় জসিম (৪০)নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল এর প্রভাবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাঁচ হাজারেরও বেশি কাঁচা ঘর বাড়িবিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানের যারা জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে অত্যন্ত ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ রয়েছেন পানিবন্দি অবস্থায়। গবাদিপশু গরু, মহীষ, হাঁস মুরগী, ছাগল,পুকুরের মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। পানের বরজ ও ফসলী জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বেড়ীবাঁধের বাহিরে চর অঞ্চলের মানুষ এখনো অনেকে জোয়ারের পানিতে আটকা পড়ে আছেন।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতির পড়েছে চরফ্যাশন উপজেলা ঢালচর ও কুকরি-মুকরি ইউনিয়নের মানুষ। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন ওই দুটি ইউনিয়ন হওয়ায় সামান্য জোয়ারের পানিতেই তলিয়ে যায় ইউনিয়নের সকল রাস্তাঘাট সহ বিভিন্ন স্থাপনা। তাছাড়া বেরিবাধ না থাকায় ভোগান্তির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের।
ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাম হাওলাদার বলেন, গতকাল রোববার থেকেই অতি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে আছে পুরো ইউনিয়নটি। পানির চাপে ভেসে গেছে বহু মানুষের গবাদি পশু গরু ছাগল হাঁস-মুরগি সহ বিভিন্ন পুকুর মাছের ঘেরের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। কিভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন এই ইউনিয়নের মানুষ তিনি কেন তা কারোরই বোধগম্য নয়।
একই চিত্র তুলে ধরে পাশের ইউনিয়ন কুকরি-মুকরির চেয়ারম্যান আবুল হাশেম মহাজন বলেন, গতকাল আবহাওয়ার পরিস্থিতি খারাপ দেখি ইউনিয়নের নিম্না অঞ্চলের বহু মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে। কিন্তু রাতের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেয়ে ইউনিয়নের শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তলিয়ে আছে ইউনিয়নের বহু মানুষের ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট সহ বিভিন্ন স্থাপনা। এই মুহূর্তে তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যদের মাঝে শুকনো খাবার বিশুদ্ধ পানি সহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সরবরাহ করা যাচ্ছেন।
অন্যদিকে মনপুরা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিতে তলিয়ে প্লাবনের মধ্যে রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। তীব্র বাতাসে ভেঙ্গে গেছে বহু মানুষের ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন, শাহেআলম, নিলুফা বেগম, বিবি ফাতেমা বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেরিবাদ না থাকায় সামান্য জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় আমাদের মত নিচু এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি। পানির পরিমাণ এতোই বেশি যে ভাটার সাথে পানির নামতে নামতেই আবার জোয়ার এসে পুরো এলাকা তলিয়ে ঘরবাড়ি পানির নিচে ডুবে যায়।
এ ব্যাপারে উপজেলার হাজির হাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহরিয়ার দীপক চৌধুরী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র রীতিমতোই তাদেরকে আমরা খাবার-দাবার সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে হয়তো বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা করা যাবে।
তাছাড়া টানা বৃস্টি ও জোয়ারের পানিতে চলতি বোরো আবাদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন জেলা কৃষি বিভাগ। তারা ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টরে বোরো আবাদের যে লক্ষমাত্রা নিয়ে চাষীদের পাশাপাশি তারা মাঠে কাজ করছেন। বর্তমান ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বড় একটি অংশ ক্ষতির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন জেলার কৃষি বিভাগ।
এটিকে ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তারে গাছ পালা উপরে পড়ে বিদ্যুতের লাই ছিড়ে যায়। এতে করে গত রোববার সকাল থেকে বিদ্যুৎহীন রয়েছে পুরো জেলার মানুষ।
এ ব্যাপারে ভোলার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (ওজোপাডিকো) কাউসার আহমেদ বলেন, বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যুতের সংযোগ লাইনে গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ঝড়ের মধ্যেও ওই সকল লাইনগুলো সংস্কারে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন মাঠে কাজ করে চাচ্ছেন। আমরা আশা করছি সন্ধ্যার পরপরই পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু জায়গার বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করতে পারবো।
ভোলা জেলা প্রশাসক মোঃ আরিফুজ্জামান বলেন, অতীতে যে সকল ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সে সকল ঝড় অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভোলা ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব টানা দুই দিন যাবত চলছে। তাই টানা দুই দিনের ঝড়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানুষের জানমালসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে এ সকল ক্ষতির তালিকা নিরূপণ করে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে যথা সম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।