সকাল থেকেই পুরো জেলা জুড়েই ছিলো টানা বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়া। দুপুর হতে বাতাসের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথেই শুরু হয় ঝড়ের তান্ডব। প্রায় ঘন্টা ব্যাপী চলা ভারী বর্ষণ ও তীব্র বাতাসে জেলার বিশেষ করে বোরহানউদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলা সহ বিভিন্ন স্থানে আরে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙ্গে ও উপরে পড়েছে শতাধিক গাছপালা।
চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাম হাওলাদার জানান, তার ইউনিয়নে তাই অর্ধশত ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। যদি বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংখ্যা পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও এর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
ঝড়ের তান্ডবে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়েন পাশের ইউনিয়ন চর কুকরি-মুকরি ইউনিয়ন। সেখানকার চেয়ারম্যান আবুল হাসান মাহাজন জানান, তার এলাকায় বহু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এর সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০টিরও বেশি ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান তিনি। এছাড়াও চরফ্যাশনের আরো কয়েকটি ইউনিয়নে বিচ্ছিন্নভাবে বেশকিছু ঘরবাড়ি পড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একইভাবে বোরহানউদ্দিন উপজেলা সহ আরো কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর বাহিরে প্রায় শতাধিক গাছপালা ভেঙ্গে ও উপরে পড়েছি।
এছাড়া দুপুরের দিকে তজুমউদ্দিন উপজেলার মেঘনা নদীতে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। ট্রলারে থাকা অধিকাংশ মাঝি মোল্লারা জীবিত উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বাদশা মিয়া (৫৫) নামের এক জেলে। বিষয়টি নিশ্চিত করে তজুমদ্দিন থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাকসুদুর রহমান মুরাদ জানান, নিখোঁজ জেলেকে উদ্ধারের ব্যাপারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এছাড়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রোপা আমন ধান। দিনভর টানা বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলার আমন ধান গাছ জমিতে হেলে পড়েছে। তাতে করে প্রাথমিকভাবে শতাধিক হেক্টর জমির আমনে ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে এই ক্ষতির সম্পূর্ণ নিরূপণ করার পর এর পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে জানান তারা।
পাশাপাশি শীতের শাক সবজি সহ বিভিন্ন ধরনের ফসলেরও বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ। জমিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি সরে গেলে হয়তোবা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া বড় একটি লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়েছে জেলার শতাধিক ইটভাটার মালিকদেরকে। মৌসুমের শুরুতেই প্রতিটি ইটভাটায় লাখ লাখ কচাইট তৈরি করে রৌদ্রের শুকাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু দিনভর বৃষ্টিতে জেলার প্রায় ছয়টা থেকে ইটভাটায় তৈরি করে রাখা কাঁচা ইট বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে। এতে করে তাদের প্রায় কয়েক কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে জানান অধিকাংশ ভাটার মালিকরা।
তবে বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে দুর্গম অঞ্চল সহ উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ গুলো স্ব-স্ব এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সকাল থেকেই নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় ভোলার সাথে সারাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। এতে করে বন্ধ হয়ে পড়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে ভোলাতে আসা কাঁচামাল সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আনা নেয়ার কাজ। এর সাথে ভোলা-লক্ষীপুর ও ভোলা-বরিশাল রুটের ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় দুই খাটের এপার ওপার আটকে আছে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক সহ বিভিন্ন পণ্যবাহী শত শত যানবাহন।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাত ৯ টায় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ সময় সভার সভাপতি ভোলা জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, যেকোনো ধরনের দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলার ৭ উপজেলায় খোলা হয়েছে ৮টি কন্ট্রোল রুম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৮৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ১২টি মুজিব কেল্লা। যদিও সকল আশ্রয় কেন্দ্র ও মাটির কিল্লা গুলোতে সাধারণ মানুষসহ গবাদি পশু আশ্রয় নেয়া শুরু করেছে।
তাছাড়া প্রস্তুত রয়েছে ৯২টি মেডিকেল টিম। এর সাথে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, ত্রাণের চাল ও নগদ টাকা।
বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনাসহ তাদের সচেতন করার লক্ষে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির আওতায় ১৩ হাজার সিপিপি, ৮০০ স্বেচ্ছাসেবক ও রেড ক্রিসেন্টের ২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা প্রস্তুতি নিয়ে মাইকিং সহ বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে লোকজন আনা নেয়ার কাজ করছে।
একই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বেড়িবাঁধ যেনো ছুটে না যায় এর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এরই মধ্যে দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। পাশাপাশি রয়েছে ৩৪১ টন চাল ও শিশু খাদ্যের জন্য ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং গো-খাদ্যের জন্য ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ।
এছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘোষণা মোতাবেক ভোলায় ৭ নম্বর সতর্কতার সংকেত জারি করা হলেও পরবর্তীতে তাদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা পুরোপুরি নিরূপণ করে এরপর ঘর সংস্কারের জন্য তাদের মাঝে টিন ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে বলেও জানান তিনি।