এইচ এম জাকিরঃ ভোগান্তির আরেক নাম ভোলার কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস। ঘুষ আর অনিয়মই যেন এই অফিসের নিয়ম। প্রতিদিন আঙ্গুলের ছাপ দিতে আসা শত শত বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভুতভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এখানকার অফিস প্রধান মোশারফ হোসেন নিজেই কিংবা তার নির্ধারিত কয়েকটি দালাল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিচ্ছেন এ সকল টাকা। এতে করে প্রতিদিনই আঙ্গুলে ছাপ দিতে আসা শত শত বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তীতে।
দেখা গেছে কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান, মালএশিয়া, দুবাই, কাতার সহ বেশ কয়েকটি দেশে শ্রমিক ভিসায় যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের নীতিমালা অনুসারে সংশ্লিষ্ট দেশের দুতাবাসের ইস্যু করা ভিসার সত্যায়ন কপি প্রাপ্তি সাপেক্ষে স্ব-স্ব জেলার জনশক্তি ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরো কার্যালয়ে কোন ধরনের ফি ছাড়াই আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার বিধান রয়েছে। অথচ দ্বীপ জেলার ভোলার কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যকলাপে দেখা যায় একেবারেই ভিন্ন চিত্র।
প্রতিদিন এখানে আঙ্গুলের ছাপ দিতে আসা শত শত বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে পড়তে হচ্ছে চরম বিরম্বনায়। টাকা নেয়ার বিধান না থাকলেও প্রতিটি কাজেই এখানে দায়িত্বরত অফিস কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাতে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। কোন ব্যক্তি টাকা দিতে অপারাগতা প্রকাশ করতেই তাকে হতে হয় হেনস্তার স্বীকার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিরা আঙ্গুলের ছাপ দিতে চলে আসেন ভোলা পৌর এলাকার কালীনাথ রায়েরবাজার এলাকার খালপারের সড়কের কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে। এরপর আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে পিন্ট বের হতেই দেখা যায় এক দেশের জায়গায় চলে আসছে আরেক দেশের নাম। অর্থাৎ কাতার যাওয়ার ব্যক্তির চলে আসে ডুবাই বা সৌদিআরব যাওয়ার ব্যক্তি চলে আসছে সিংঙ্গাপুর। এরপর এ কাজের দায়িত্বে থাকা অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার আপারেটর মোঃ শরিফ হোসেন প্রিন্টের সংশধনের জন্য অফিস ভবনের নিচতলায় থাকা মা কম্পিউটার নামের তাদেরই এক দালাল প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে সংশোধনীর জন প্রতি নেয়া হয় ১২শ’ টাকা। এর সাথে দেয়া হয় জবশিখা নামের আরেকটি ফরম। সেখানে নেয়া হয় ২ থেকে ৩শ’ টাকা। অফিস খরচ দেখিয়ে এ ভাবে টাকা নেয়ার পরও চা-পানির খরচা বাবদ আরো দিতে হয় দেড় দুইশত টাকা।
শুধু তাই নয়, পুর্বের পাসপোর্টদারী ব্যক্তিদেরকে পরতে হয় আরো ভোগান্তীতে। দেখা গেছে, আঙ্গুলের ছাপ দিতে আসা নতুন পাসপোর্ট অর্থাৎ ই-পাসপোর্টদারী ব্যক্তিদেরকে ব্যাংকে জমা দিতে হয় ২২০ টাকা। কিন্তু পুরাতন পাসপোর্টদারীদের ক্ষেত্রে আবার এই টাকাটা ব্যাংকের পরিবর্তে দিতে হয় বিকাশ, নগদ কিংবা রকেট একাউন্টে। ততে দেখা যায়, অফিসের লোকদের এ সকল একাউন্টের মাধ্যমে এ টাকা পেমেন্ট করা হলে সেই ক্ষেত্রে এক দুই দিন বিলম্ব দেখিয়ে ঢাকা হেড অফিসের মাধ্যমে এ কাজ দ্রুত করানোর অজুহাতে ওই সকল প্রবাশীদের কাছ থেকে জন প্রতি নেয়া হচ্ছে ৮-১০ হাজার টাকা। কখনো তার চেয়েও কয়েক গুন বেশি।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধা পর্যন্ত শহরের খালপাড়ের জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে দেখা যায় বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদের পদচারনা। কেউ কেউ বাড়তি টাকা দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করে চলে যেতে পারলেও অধিকাংশরাই না জেনে বাড়ি থেকে বাড়তি টাকা না নিয়ে অফিসে এসে তাদেরকেই পড়তে হয় নানা বিরম্বনায়।
কথা হয় সৌদিআরবে যেতে ইচ্ছুক চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ চর মাদ্রাজ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ শাহিনের সাথে। অফিসে আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার পর কম্পিউটার থেকে তার তার ফিঙ্গার পিন্ট বের হতে দেখা যায় তার পছন্দের সৌদিআরবের স্থানে চলে আসছে কাতার। বিষয়টি দেখেতো তার চোখ যেনো কপালে ওঠে গেছে। অবশ্য মহুর্তের মধ্যেই এর সমাধানের পথও দেখিয়ে দিলো এই কাজের দায়িত্বে থাকা অফিস সহকারি, (কম্পিউটার অপারেটর) মোঃ শরিফ দেশের নাম সংশোধনের জন্য অফিস ভবনের নিচেই থাকা মা কম্পিউটার নামের ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তা সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলে। এরপর সেই প্রতিষ্ঠানে এ কাজের সংশোধনীতে বাধ্যতামূলক ভাবে দিতে হয়েছে ১২শ’ টাকা। এরসাথে করতে হয় জবশিকা নামক আরো একটি ফরম। তাতেও দিতে হয় ৩শ’ টাকা। একই কাজে এসে বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাসাননগর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাকও দেখতে পায় তার ফিঙ্গার প্রিন্টে দৌদিআরবের স্থানে চলে আসছে ওমান। সংশোধনের জন্য তাকেও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানে। এরপর ১২শ’ টাকা খরচের মধ্য দিয়ে সংশোধন হয়েছে পরিবর্তিত হওয়া দেশের নাম। লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা মোঃ সোহেলেও ফিঙ্গার প্রিন্টে কুয়েত এর স্থানে চলে আসছে ডুবাই। সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মেইদি হাসানেরও সৌদিআরবের স্থানে চলে আসছে কাতার। একই কাজে মনসুর, জুয়েল, মাহফুজ, লিটন সহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা প্রতিটি ব্যক্তিকেই একই ভাবে ভোগান্তীতে পড়তে হয়েছে।
শুধুই তাই নয়, পুর্বের পাসপোর্টদারী ব্যক্তিদেরকে পরতে হয় আরো ভোগান্তীতে। কেননা নতুন পাসপোর্ট অর্থাৎ ই-পাসপোর্টদারী ব্যক্তির ২২০ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া লাগলেও পুরাতন পাসপোর্টদারীদের ক্ষেত্রে সেই টাকা দিতে হয় বিকাশ, নগদ কিংবা রকেট একাউন্টে। তাতে করে ওই সকল প্রবাশীদেরকে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দেখিয়ে তাদের কাছ থেকেও জন প্রতি নেয়া হচ্ছে ৮-১০ হাজার টাকা।
তেমনী এক সৌদি প্রবাসী লালমোহন উপজেলার ভেদুরিয়া গ্রামের সিরাজিয়া মাদ্রাসা এলাকার বাসিন্দা মোঃ হান্নানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, অফিসের লোকদের এ সকল একাউন্টের মাধ্যমে ২২০ টাকা টাকা পেমেন্ট করা হলে সেই ক্ষেত্রে এ কাজের বিভিন্ন ধরনের ক্রতি দেখিয়ে হেড অফিসের মাধ্যমে এ কাজ দ্রুত করানোর অজুহাতে তার কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৮ হাজার টাকা। একই উপজেলার হাসান নগর ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সৌদিপ্রবাসী ফাহফুজের কাছ থেকেও নেয়া হয়েছে ১১ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি পাশের উপজেলা বোরহানউদ্দিনের বড়মানিকা ইউনিয়নের বাসিন্দা সৌদিপ্রবাসী মাহাবুব এর কাছ থেকেও একই কাজে নেয়া হয়েছে ১২ হাজার টাকা দাবী করলে সে অনেক কাকুতী মিনতী করে ৮ হাজার টাকা দিয়ে তার কাজটি করিয়ে নিয়েছেন বলে জানান।
যদিও এ সকল টাকা মাঝে মধ্যে হেন্ডকেস নেয়া হলেও অধিকাংশ সময়ই অফিস প্রধান মোশারফ হোসেনে ০১৭১২৭০৮৪৬৮ এই নাম্বারে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মাধ্যমে নেয়া হয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
এদিকে ফিঙ্গার প্রিন্টে এক দেশের স্থানে আরেক দেশ চলে আসার বিষয়ে জানতে অফিস সহকারি কম্পিউটার অপারেটর মোঃ শরিফ হোসেনের সাথে কথা হলে বিষয়টি গোপন রাখার প্রতিশ্রুতিতে তিনি বলেন, সবই হচ্ছে আমাদের কারসাজি। স্যারে আমাদেরকে যে ভাবে বলে আমাকেতো সে ভাবেই করতে হয়। যদিও কিছু কিছু সঠিকই প্রিন্ট বের করতে হয়। তা না হলে আবার বিভিন্ন জনের প্রশ্নের সম্মুক্ষিন হতে হবে।
একই ভাবে বিষয়টি গোপন রাখতে বলে সংশোধনের জন্য ১২শ’ টাকা নেয়ার বিষয়ে অফিসের নিচে মা কম্পিউটারের মালিক মোঃ বাবুল এর ছেলে প্রান্ত জানান, ১২শ’ টাকার ২শ’ টাকা আমরা পাই, আর ১ হাজার টাকা অফিস প্রধান মোশারফ স্যারকে তার পার্সনাল নাম্বারের কখনো বিকাশ আবার কখনো নগদ একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়।
যদিও কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস প্রধানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পুর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন উল্লেখ করে অফিস প্রধান মোঃ মোশারফ হোসেন বিষয়ঢিকে হাসিরছলে উড়িয়ে দিয়ে এ নিয়ে কোন সংবাদ প্রচার না করতে এই প্রতিবেদককে বিভিন্ন ভাবে ম্যানেজের চেষ্টা করেন তিনি।
এদিকে দীর্ঘ দিন যাবত এই কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে চলা অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি ওপেন সিকরেট হলেও এ নিয়ে একেবারেই নির্বিকার জেলা প্রশাসন এমনটি দাবী করে ভোলার বিভিন্ন সচেতন মহল এটিকে খুবই দুঃখ ও লজ্জাজনক আক্ষাদিয়ে ভোলা প্রেসক্লাব সভাপতি এ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি অধিকাংশ অফিসেই কম বেশি হয়ে থাকলেও ভোলার কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে ব্যপক ঘুস বানিজ্যের কথা শুনা যায় আমাদেরই বহু আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে। আসলেই আমাদের ভোলার জনগনের জন্য এটি খুবই লজ্জাজনক। একই কথা বলে ভোলার দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোবাশি^র উল্লাহ বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ গরীব অসহায় ব্যক্তিরা সহায় সম্বল বিক্রি করে বিদেশ গিয়ে তাদের কষ্টে উপার্জিত রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির একটি বিশাল ঘাড়তি পুরণ করে। অথচ সেসকল মানুষ গুলোকে এই অফিসের অসৎ কর্মকর্তার দিনের পর দিন চুষে খাচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর শস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা দরকার বলে আমি মনে করি।
যদিও বিষয়টি নিয়ে এর আগে কেউ কোন ধরনের অভিযোগ করেনি। তবুও বিষয়টি খতিয়ে দেখে এর সত্যাতা পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেন ভোলা জেলা প্রশাসক মোঃ আরিফুজ্জান।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত