তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বহু বছর যাবতই ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ভাংতিরখাল ও কাচিয়া ইউনিয়নের কাঠিরমাথা সহ মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যবহার হচ্ছে মৎস্য ধ্বংশকারী শতাধিক নিষিদ্ধ বাধাজাল। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিদিন নদী থেকে ধ্বংশ করা হচ্ছে শত শত মন ঝাটকা ইলিশ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেনুপোনা। একই ভাবে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে খুঁটি গেড়ে তার সাথে ক্ষুদ্র ছিদ্র বিশিষ্ট মশারি জালের মতো একটি বিশেষ জাল বেঁধে নদী থেকে কাচিয়ে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার মন জাটকা সহ সকল ধরনের মাছ ও মাছের পোনা। অধিকাংম সময়ই দেখা যায় নদীতে ভাটা শুরু হওয়ার পরই নদীর পানি কমে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে জেগে ওঠা ডুবোচর গুলোর কয়েক কিলোমিটার জুড়ে আগ থেকেই খুঁটি গেড়ে এর সাথে জাল বেধে রাখা হয়। জোয়ারের সময় ওই চরে জমে থাকা পলিতে ইলিশ, পোয়া, বেলে ও চিংড়িসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ও মাছের পোনা চলে আসে। এরপর ভাটা হওয়ার মূহুর্তে নিচে থাকা জাল গুলেকে প্রতিটি খুটির উপরের অংশে বেধে দেয়া হয়। এরপর ভাটার সাথে পানি নেমে জালে আটকা পড়ে ঝাকে ঝাকে জাটকা ইলিশ, ইলিশের পোনা (চাপলি মাছ) সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
সাধারণ জেলেরা বলছেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে স্থানীয় কিছু প্রভাশালী কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে খুঁটাজাল ও বাধাজাল ও পিটানোজাল নামের বিশেষ এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে নদী থেকে প্রতিদিন শত শত মন জাটকা ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছের রেনুপোনা নিধন করছেন।
ধনিয়া কাঠিরমাথা এলাকার জেলে মহসিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমাদের মতো সাধারণ জেলেদের বেলায় আইনের অভাব নেই, আমরা সামান্য দুই হাজার টাকার কারেন্ট জাল ব্যবহার করলেও প্রশাসনের লোকজন আমাদের জাল গুলো ধরে মুহুর্তের মধ্যেই সেগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অথচ নদীতে বড় বড় মিয়া ভুইয়াদের নিষিদ্ধ জল গুলো তাদের চোখে পড়ে না।
নদীতে নিষিদ্ধ জালের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি এলাকার বশার মাঝি বলেন, নদীর মধ্যবর্তী সিমানার ডুবোচর গুলোর প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ২৫-৩০ ফুট লম্বা খুটি গেথে এরসাথে বেধে দেয়া হয় জাল। জোয়ারের পানিতে পুরো চরটা ডুবে গেলে ওই চরে জমে থাকা মিষ্টি পলিমাটি খেতে আসা ইলিশ ও জাটকা ইলিশ, পোয়া, বাটা, বেলেসহ দেশীয় সকল প্রকার মাছ ও মাছের রেনুপোনা এসকল চরগুলোতে আশ্রয় নেয়। এরপর ভাটার স্রোতের সাথেই মাছ গুলো ওই জালে আটকা পরে। তাছাড়া বেড়িকেট দেয়া জালের জন্য চরে আসা মাছগুলো অন্যত্র যেতে না পেরে ওই চরের সামন্য পানিতে ছুটোছুটি করে। ওই পানি থেকে মুসুরি জালের মাধ্যমে সকল প্রকার মাছের মাছ মাছে পোনা পানি ছেকে তুলে আনা হয়।
একই এলাকার শাহাবুদ্দিন মাঝি বলেন, খুটি জলের চেয়ে আরো ভয়াবহ হচ্ছে বাধাজাল। যার মধ্যে মাছের রেনুপোনা সহ মাছের ডিম পর্যন্ত আটকে পড়ে। এই জালের মাধ্যমে পুরো নদী থেকে সকল ধরনের মাছ ছেকে ধরা হয়। যেগুলো খাওয়ার উপযোগী সেগুলো রেখে বাকি সকল ধরনের মাছের রেনুপোনা ফেলে দেয়া হয়।
নদীর জন্য এ জাল অত্যান্ত ক্ষতিকর বলে ইলিশা এলাকার নুর ইসলাম মাঝি বলেন, পাঁচ লাখ মিটার কারেন্ট জাল নদীর যতটুকু ক্ষতি করতে পারে তার চেয়ে কয়েক গুন বেশি ক্ষতি করছে খুঁটা জাল ও বাধা জাল। আমাদের মতো সাধারণ জেলেরা হয়তো কিছু কারেন্ট জাল ব্যবহার করলেও কারেন্ট জালে রেনুপোনা ধ্বংশ করে না বড় ইলিশের পাশাপাশি এ জালে আটকা পড়ে কিছু জাটকা ইলিশ। কিন্তু বড় বড় মিয়াদের বাধাজাল, খুটিজাল শুধু জাটকা ইলিশই নয়, এ জাল দিয়ে সকল ধরনের মাছ ও মাছে রেনুপোনা নিধন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে পেশার লোকজন বলছেন, বিগত বছর গুলোতে ইলিশা ভাংতিরখাল নামক এলাকার পুরো মেঘানা নদী দখল করে স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক ব্যাপারী ও তার ভাতিজা একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ফরিদ দুজনই হচ্ছে অত্র অঞ্চলের নিষিদ্ধ জালে জনক। এদের মতো এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করেছেন পাশের ইউনিয়ন কাচিয়া কাঠির মাথা নামক এলাকার পলাশ মুরাদার ও হাসেম ব্যপারী। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী সরকার পতনের সাথেই তারা কিছুটা হালকা দিলেও একই স্থানে তাদেরই জাল গুলো ব্যবহার করছেন অন্য গ্রুপ। প্রকাশ্য দিবালকে নদীতে নিষিদ্ধ বাধাজাল, খুটিজাল ও পিটানো জাল বসিয়ে রীতিমতো পুরো নদী দখল করে রেখেছে।
মৎস্য ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, এ সময় নদীতে ইলিশের পোনা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা বৃদ্ধি পায়। তাই এ সময় গুলোতেই নদীতে ব্যবহার করছে ক্ষমতাশীন দলের প্রভাশালী মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিষিদ্ধ জাল। এ সব নিষিদ্ধ জালের বিষয়ে কোস্টগার্ড ও মৎস্য কর্মকর্তাদের জানানো হলেও তাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
শুধু ভোলা সদর উপজেলাই নয়, প্রতিনিয়তই এ ধরনের নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ভোলার দক্ষিণের দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলার মেঘান ও তেতুলিয়া নদীতে। প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের এ সময় গুলোতে ইলিশের প্রজনন মৌসুমের সময় নদীর অভয়াশ্রমে ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে মা ইলিশ নদীতে চলে আসে। এই সময় গুলোতে পুরো নদী জুড়ে মা ইলিশ ও ইলিশের পোনা সহ বিভিন্ন প্রজাতিক মাছের পোনা গুলোর চলে অবাদ বিচরণ। ঠিক এই সময় গুলোকেই বেছে নিয়ে কিছু অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ী নিষিদ্ধ জাল দিয়ে নদী থেকে ধ্বংশ করছে মা ইলিশ ও ইলিশের পোনা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
এদিকে নদী থেকে এ সকল নিষিদ্ধ জাল ধ্বংশ ও উৎখাত করতে জেলা মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে আসলেও পরক্ষণেই দেখা যায় ফিরে আসছে একই অবস্থায়। সর্বশেষ গত ২৩ সেপ্টেম্বর বুধবার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব ও দৌলতখান উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহাফুজুর রহমানের নেতৃত্বে কোস্টগার্ডের একটি চৌকস দল সদর উপজেলার মেঘনার দুটি পয়েন্টে নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
এ সময় নদীতে সারি সারি ভাবে পুতে রাখা প্রায় ৩ হাজার পিচ খুটি ও ১৬০টি নিষিদ্ধ চরঘেরা মশারী জাল জব্দ করা হয়। এর আগেও ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর দৌলতখান উপজেলার মেঘনা নদীতে একই ভাবে অভিযান পরিচালনা করে নদীর কয়েকটি পয়েন্টে মাইলের পর মাইল পুতে রাখা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার খুটি ও বিপুর পরিমান নিষিদ্ধ জাল নদী থেকে উৎক্ষাত করে তা বিনষ্ট করা হয়।
তবে সপ্তাহ পার হতে না হতেই একই স্থানে পুনরায় বসানো শুরু করেছে ওই সকল নিষিদ্ধ জাল। কিন্তু কিভাবে নদী এ ধরনের নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার চলছে তা কারোরই বোধগম্য নয়।
এ ব্যপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, নদীতে যে কোন ধরনের নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ যাবত বাধাজাল, খুটিজাল সহ অশংখ্য নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে নদী থেকে এ ধরনের জাল উৎখাত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এরপরও তাদের অজান্তে কোন কোন স্থানে নতুন করে এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার শুরু করেছে এ ধরনের কোন অভিযোগ পাওয়ার সাথেই ওই সকল জাল ও জাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অবার অভিযান পরিচালনা হবে বলে জানান তিনি।